সেই ছোটবেলা থেকেই এর সূত্রপাত- আবীরে বয়স যখন ১১ বা ১২ বছর তখন থেকেই। অবশ্য তখন আর এখনের পার্থক্য হলো- তখন দেয়ালে আবীর ঝুলাতেন বীজগাণিতিক সূত্র আর জ্যামিকি সংজ্ঞা আর এখন সেঁটে রাখেন তার প্রিয় মানুষগুলোর মুখ। সকালে ঘুম ভেঙেই যখন তিনি দেখেন রবীন্দ্রনাথের মুখ, তার মনটা ভালো হয়ে যায়। নিজের ভেতর একটা কিছুর তাড়না তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর তিনি সারাদিন থাকেন তরতাজা, অনেক অনেক কাজ করে ফেলেন কোনোরকম ক্লান্তি ছাড়াই।
অর্ণবের গান ভালো লাগে মিতুর। তাই মিতুর কাছে বিনোদন মানে গান, আর গান মানেই অর্নবের গান। শুধু কি তা-ই? তার বেডরুম জুড়ে বিরাজ করছে অর্নবের পোস্টার। চার দেয়াল জুড়ে সেঁটে রাখা হয়েছে সেসব পোস্টার। গান শুনতে শুনতে আর পা দোলাতে দোলাতে সেব নানান রঙে, নানান ঢঙে তোলা অর্নবের ছবিগুলো দেখলেই মিতুর অনেক ভালো লাগে। কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লাগে। আহা, একটা মানুষ এতো গুণী হয় কীভাবে? কীভাবে সম্ভব এতো এতো সুন্দর গান করা? মিতু নিজের ভেতরে একটা তাড়না অনুভব করেন। ভালো কিছু করতে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠেন তিনি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে।
দেয়াল জুড়ে আলোর প্রাণ…
এই যে দেয়াল জুড়ে মানুষ নিয়ে বা কোনো দৃশ্য নিয়ে কিংবা আঁকাজোকা নিয়ে এতো এতো কিছু, কেন এসব? এই বিশেষজ্ঞগণ বিস্তর গবেষণা করেছেন। কিন্তু সেসব ভারিক্কি কথাতে আমরা না যাই। বরং আমাদের আশেপাশের চেনাজানা দৃশ্য থেকেই আমরা কথা বলে জেনে নেয়ার চেষ্টা করেছি কেন এসব?
দেয়াল যেন মনের আয়না…
খোঁজ-খবর এবং বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে যতটুকু জানা গেলো- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এটা হয়ে থাকে সাধারণত নিজের ভালোলাগা এবং কারও প্রতি ভালোলাগার পরের ভালোবাসা থেকেই। মূলত নিজের ভেতরের ভাবনার পরিস্ফূটন-ই দেখা যায় দেয়াল জুড়ে। আবীর ভালোবাসেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা না পড়লে তার ভালো লাগে না, গান না শুনলে তার দিন চলে না, উনার ছোটগল্পগুলো আবীরকে অনেক ভাবায়… জীবন নিয়ে, বাস্তবতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এতো এতো কাজ তাকে অনেক অনেক উৎসাহিত, অনুরণিত করে। তাই দেয়াল জুড়ে আবীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেঁটে রেখেছেন রবীন্দ্র দুনিয়া- রবীন্দ্রনাথের ছবি, গান লেখা পোস্টার, হাতে লেখা কবিতা ইত্যাদি। তেমনি মিতুর বেলাতেও তাই। তেমনি আরও আরও অনেকেও তা-ই করেন। নিজের মনের ভাবনাই প্রকাশ করেন দেয়ালে। আবার কেউ হয়তো শুধু রঙ মেখেই দেয়ালকে করে তুলেন নিজের ভাবনার জগৎ। কেউ আবার দেয়ালকে করে তুলেন সাগর সৈকত। ঘুমানোর আগে বেডরুমটা হয়ে উঠে ফেনীল নীল সমুদ্র!
কারা সেঁটে থাকেন দেয়ালে?
এই লিস্টে রয়েছেন নিজের কাছের মানুষ যেমন- বাবা-মা, নিজের ভাইবোন, তেমনি রয়েছেন গায়ক-গায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নর্তক-নর্তকী, খেলোয়ার, কোনো লিজেন্ড পারসন, ইতিাহাসের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র, ল্যান্ডস্কেপ। আরও আছে রঙের খেলা, দৃশ্যের মাতোয়ারা, নিজের ভেতরের কাব্য প্রতিভা, গায়কী প্রতিভা। এবং আছে নিজের আঁকা দৃশ্য, কার্টুন, গীটারসহ আরও প্রাত্যহিক অনেক কিছু। মূলত নিজের ভালোলাগা আর ভালোবাসার ব্যাপারটাই ফুটে উঠে নিজের দেয়ালে। বলা যায়- একটা মানুষের বেডরুম দেখেও অনেক কিছু হিসাব করা সম্ভব ঐ লোকটা সম্পর্কে। যেমন- যিনি বার্সেলোনার সমর্থক, তিনি কখনই রিয়েল মাদ্রিদ ক্লাবের খেলোয়ারদের ছবি নিজের রুমের দেয়ালে সেঁটে রাখবেন না।
টিনএজার মন…
এই ব্যাপারটা সাধারণত টিনএজারদের মাঝেই বেশি দেখা যায়। কারও সম্পর্কে খুব ক্রেজি হয়ে ঐ সেলিব্রেটির ছবি নিজের শোবার ঘরের দেয়াল জুড়ে সেঁটে রাখে। ভালোবাসার বহি:প্রকাশই এটা এতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য এর বিকল্প ধারাও লক্ষ্য করেছেন বিশেষজ্ঞগণ। সে কথায় পড়ে আসছি। টিনএজ বয়সটা যেহেতু একটু বাউ-ুলে টাইপের, তাই অনেক ক্ষেত্রেই সেসব ছবি, পোস্টারের কিছু কিছু শালীনতার ধাপ টপকে যায়। ফলে দেখা যায়Ñ অনেক টিনএজারই নিজের ঘরে বাবা-মা বা পরিচিত কাউকে এলাউ করে না বন্ধু-বান্ধব এবং সমবয়সী কাউকে ছাড়া। যদিও অনেক বাবা-মা বিষয়টাকে সহজভাবে নেন, এবং নিজের সন্তান একটু বড় হলেই, ঘরে প্রবেশ করার আগে দরজায় নক করে প্রবেশ করেন। কিন্তু এই ট্রেন্ডটা আমাদের দেশে, সমাজে এখনও পরিপূর্ণতা পায়নি। ফলে অনেকক্ষেত্রেই এটা নিয়ে পরিবারের সাথে সামান্য সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে যায়। দেয়ালে ছড়ানো ভালোবাসা তখন মনের গহীনে আঘাত করে নিজের অজান্তেই। যা থেকে অনেক টিনএজারই একটু বেপরোয়া হয়ে উঠে আর নিজেকে ঠেলে দেয় নেশার জগতে বা কোনো ভয়ংকর পথে।
ক্ষতির সম্ভাবনা?
না, এটা মোটেও তেমন কোনো ক্ষতির কারণ নয়। যদি না সেটা একেবারেই নিজের আয়ত্বের বাইরে চলে যায়। এমন অনেকে আছেন যিনি, কিছু সেলিব্রেটি বা লিজেন্ডের প্রতি এতোটাই আসক্ত হয়ে পড়েন যে, নিজেকেও ঐ লেভেলের ভাবতে থাকেন। ধীরে ধীরে যা মানসিক রোগের দিকে তাকে টেনে নিয়ে যায়।
আসলে ব্যাপারটা খুবই সহজ আবার একটু কঠিনও। আপনি যদি নিজের দেয়ালকে রাঙিয়ে তুলেন নিজেকে উৎসাহিত করতে, অনুপ্রাণিত করতে, আন্দোলিত করতে নিজের মননকে তাহলে সেখানে দোষের কিছু থাকতে পারে না কিছুতেই। আর যদি আপনি মনে করেন এটা আপনাকে করতেই হবে, না করলে জীবন হয়ে যাবে অতীষ্ঠ, মূল্যহীন, তাহলে বলবো আপনি কিঞ্চিত ভুলের মাঝেই আছেন। নিজের লাগাম টেনে ধরুন নিজের মাঝেই নিজে হারিয়ে যাওয়ার আগে।
সমাপ্তিকথন
যে ভালোবাসা লালন করেন নিজের মাঝে সেটা কখনোই খারাপ হতে পারে না। তবে ভালোবাসা যদি আসক্তিতে পরিণত হয় তাহলে সেটা অবশ্যই ক্ষতির কারণ আর এই ব্যাপারে দোসরা কথা বলার কোনোও সুযোগ নেই। সুতরাং যা করছেন তা করার আগে নিজের ভেতরের মানুষটাকে বারবার প্রশ্ন করে নিজের কাছে নিজে ক্লিয়ার হয়ে নেয়ার মধ্যেই সমস্যার সমাধান আছে এই ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন সবসময়।
নিজের দেয়াল হয়ে উঠুক আরও রঙিন এবং ভালোবাসাময়, ঠিক আপনার মনের নিষ্কলুষ শুদ্ধতার মতোই। রঙিন দেয়ালে ছড়িয়ে পড়–ক আপনার মনের ভালোবাসা- এই শুভকামনা সবসময়ের জন্য আপনার প্রতি। জীবন হোক আরও সুন্দর।