সময়ের তুখোড় লেখক মুবিন মেহমুদ। তার লেখায় মানুষ যেমন সোচ্চার হন, তেমনি নবজাগরণের চেতনা স্পষ্ট। নারীর উন্নয়নে তিনি সবসময়েই অগ্রগামি। নারীর সমঅধিকারে তিনি বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন নারীর যথাযথ ক্ষমতায়ন ছাড়া এই জাতির উন্নতি হবে না। য়ুরোপ-য়ামেরিকার উন্নতির পেছনে নারীর শক্ত অবস্থান তিনি তার লেখার পরতে পরতে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। সেই লেখার ধার যেমন শক্ত, আমাদের দেশের নারীরাও তেমনি সেটা স্পর্শ করতে পারেন মরমে মরমে। নারীর অবমাননাকারিকে তিনি মুখে ঝামা ঘষে দেন। সবাই বাহ বাহ করেন তার লেখা পড়ে। মুবিন মেহমুদ দিনে দিনে আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন।
দুই।
বছর কয়েক আগে মুবিন মেহমুদ বিয়ে করেছেন। তিনি যেহেতু একজন নারীবাদি লেখক, তাই বিয়ের পাত্রী দেখতে গিয়ে তিনি নারীর অবমাননা করতে রাজি হননি। অবশ্য তিনি বিয়েই করতে চাননি। যে বাধন এমনিতে স্থায়ী হয় না সেটা বিয়ের মাধ্যমে কী করে স্থায়ী হয়? তিনি তাই বিয়ে বিরোধী। যদিও এসব তার লেখায় অস্পষ্ট। পাঠক অতোটা মনযোগী হয়ে লেখা পড়েন না। মুবিন মেহমুদ খেয়াল করেছেন যেসব মেয়েরা পড়াশোনা বেশি করে, তাদের ঘাড় একটু ত্যাড়া হয়। সকালবেলায় চা আর নাস্তা তাদের হাত থেকে পাওয়া যায় না। কিন্তু তার মতো এরকম একজন আধুনিক লেখক কোনোভাবেই একটা মেট্রিক ফেল মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন না। তাই তিনি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে গ্রামের একটা মেয়েকে বিয়ে করলেন। মফস্বলের কলেজে ডিগ্রি পাস করে মাস্টার্সে পড়ছে। এরকম একটা মেয়েকেই বিয়ে করলেন। গ্রামের মেয়েরা খুব লাজুক থাকে আর কথার মারপ্যাচে তাদেরকে কাবু করে ফেলা মুবিন মেহমুদের জন্য কোনো ব্যাপার না। এসব ভেবে তিনি সেভাবেই বিয়ে করলেন।
তিন।
বিয়ে করে ঢাকায় নিয়ে আসলেন পারুল বানুকে। দেখতে শুনতে বেশ। চেহারাও সুন্দর। চোখ বড় বড়। ফর্সাও আছে। তার লেখক বন্ধুরা দেখলে টাশকি খেয়ে যাবে।
পারুল বানু। কেমন ক্ষেত একটা নাম। তবে গ্রামের মানুষ এরচেয়ে আর সুন্দর নাম কোথায় পাবে? মুবিন মেহমুদ ঢাকায় আসার পর, বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগে তাই পারুল বানুকে নিয়ে বসলেন। আগে তাকে ঘষা-মাজা করে গাঁইয়া ভাবটা শরীর থেকে ঝেরে ফেলতে হবে। তাই প্রথমেই তিনি পারুল বানুর নাম নিয়ে পাড়লেন। বানুকে ডেকে বললেন- আজকে থেকে তোমার নাম হবে পারুল মেহমুদ। মিসেস মেহমুদ বলবে কেউ জিজ্ঞেস করলে। কাগজেপত্রে হবে পারুল মেহমুদ। নির্বাচন দপ্তরে আমার উুঁচদরের বন্ধুরা আছে। ওদের বলে তোমার জাতীয় পরিচয়পত্র ঠিক করে নিতে পারবো। পারুল মেহমুদ। মনে মনে নামটা কয়েকবার আওড়ালেন বিরাট লেখক মুবিন মেহমুদ। বাহ! বেশ সুন্দরতো!
চার।
কিন্তু বেঁকে বসলেন পারুল বানু। অমোর খোদা! ইডা আপনি কী কন? বাপ-মার দেওয়া নাম, দুইটা খাসি জবত কইরা নাম থুইছে। ওইডা আমি কোন দুক্কে পাল্টায়াম? আমারে কি পেত্নিয়ে ধরছেনি? আর আপনে যে কী! বেডা মাইনষের নাম আমার নামের লগে জোড়া দিয়াম কিল্লাই?
পারুল বানুর কথা শুনে তব্দা মেরে গেলেন একুশটা জনপ্রিয় উপন্যাস লেখক মুবিন মেহমুদ। গ্রামের এই আলাভোলা সহজ-সরল মেয়েটা এসব বলছে কি? কিন্তু দমে গেলেন না মুবিন মেহমুদ। কারণ তিনি জানেন ‘কাঁচালে না নোয়ায় বাঁশ, পাকলে করে টাশ টাশ’। বাঁশ কাঁচা থাকতেই নুইয়ে বেঁধে দিতে হবে। নইলে পরে তাকে পড়তে হবে আরও ঝামেলায়। অবশ্য তার দরকার ছিলো তার লেখক বন্ধু কুদরত রহমানের মতো বাসর রাতেই কাজটা সেরে ফেলা। কুতরতের শহুরে বউ হামিদা বেগম বাসর রাতের পর হয়ে গেলো হামিদা রহমান। তাদের বন্ধুদের গেটটুগেদারে কীরকম সুন্দর করে নতুন অতিথির সাথে কথা বলে- আমি মিসেস রহমান।
শোনো, বানু কেমন পুরনো ধাচের নাম। এই নাম আজকাল চলে? তুমি এখন গ্রামের মেয়ে না। শহরের মেয়ে। শহরের আধুনিক মেয়ের সাথে এরকম বানু-ফানু নাম একদম অসুন্দর। তারচেয়ে তুমি যদি হও পারুল মেহমুদ, তাহলে অনেক সুন্দর না? আমি মুবিন মেহমুদ আর তুমি হবে পারুল মেহমুদ। মানুষ শুনেই বুঝবে আমরা স্বামী-স্ত্রী। আর তুমি যখন নিজেকে পরিচয় দিবা মিসেস মেহমুদ নামে, তখন সবাই বুঝবো তুমি আমার স্ত্রী, তুমি বিবাহিত মেয়ে। কেউ তোমার সাথে তখন রঙ্গ-তামাশাও করবে না। সবচেয়ে বড় কথা, দু’জনের নামের মধ্যে একটা রিদম থাকবে।
রিদম যদি এতোই দরকার হয় আপনের, প্রিয় সোয়ামি, তাইলে এক কাজ করেন, আপনের নামের শেষে মেহমুদ বাদ দিয়া বানু লাগায়া নেন। মুবিন বানু। আর আমি পারুল বানু। আপনাগো লেখকদের নামতো কতই ভঙ্গচঙ্গ হয়, এই নাম রাখলে আপনি আরও মহান হয়ে যাবেন। আপনার লেখাতেই তো বোধহয় লিখেছেন- নারী জাগরণের পথিকৃৎ লেখক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নিজেই জাগতে পারেন নি। নিজের নাম দিয়েই তিনি আধুনিক হতে পারেন নি। পুরুষের শিকল থেকে মুক্ত হতে পারেন নি।
‘খানকি মাগি কয় কি?’ মনে মনে গালিটা আওড়ালেন সব্যসাচি লেখক মুবিন মেহমুদ। তারমতো এতো অল্প বয়সে কেউ সব্যসাচি লেখক হতে পারেন নি। তিনি হয়েছেন তার নানামুখি লেখা দিয়ে। বিশেষ করে নারী জাগরণের উপর অসাধারণ কিছু লেখা লিখে। আর এই মাগি কিনা তার লেখা দিয়েই তাকে উদাহরণ দিচ্ছে? ইচ্ছে করতেছে মাগির পাছায় কষে দুইটা লাত্থি মারতে।
কিন্তু মুবিন মেহমুদ শুধু লেখার জোরেই জনপ্রিয় লেখক হননি। তার ঘটেও কিছু বুদ্ধি আছে। কখন রাগতে হয় আর কখন কোন আচরণ কার সাথে করতে হয় সেটা তিনি ভালো করেই জানেন। এই মাগিরে পরে শায়েস্তা করা যাবে। আপাতত তিনি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে মুখে একটা তেলতেলা হাসি টেনে নিলেন। বললেন- বেশতো, তুমি যদি তোমার আগের নামটাই বেশি পছন্দ করো, তাহলে থাক না ওটা। কী আসে যায়? আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আধুনিক শহরে এসে আধুনিক হয়ে উঠতে চাইবে, তাই আমি ওই নামটা প্রস্তাব করেছিলাম। তা বেশতো, তোমার মধ্যে গ্রামের কাঁচা মাটির সোঁদা গন্ধটাই থাক না। ওটাই আমার বেশি ভালো লাগে। তাইতো শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে বিয়ে করলাম। শহরের কি আর মেয়ের অভাব ছিলো?
তারপর মনে মনে ভাবলেন, দাঁড়া মাগি, তর তেজ কমাইতেছি। কনডম ছাড়া মাল যখন খসাবো তর ভেতরে তখন টের পাবি। মুবিন মেহমুদ জানেন, পেটে বাচ্চা আসলে তেজোদীপ্ত নারী আর সেই নারী থাকে না। স্রেফ একটা মেয়ে মানুষ হয়ে যায়। তখন তাকে দিয়ে জায়গামতো তেলও মালিশ করিয়ে নেয়া যায় নিজের চাহিদামতো। আর এই মাগিতো চাকরিও করে না। ডিগ্রি পাস দিয়ে কী এমন চাকরি হবে? দশটা টাকার জন্যও তার কাছে হাত পাততে হবে। ওরে মাগি দাঁড়া, তর রস আমি বাইর করতেছি। কিন্তু মুখে তেলতেলা হাসিটা টেনে শক্ত করে ধরে রাখলেন জনপ্রিয় নারীবাদি আধুনিক লেখক মুবিন মেহমুদ।
পারুল বানুর মুখেও একটা চওড়া হাসির রেখা ফুটে উঠলো। তার মনে হলো এটা তার প্রথম জয়। আর এই জয়টা তার একার না। সমগ্র পুরুষ জাতির বিরুদ্ধে সমগ্র নারীজাতির জয়।
পাঁচ।
বছর দুই পরের কথা। সব্যসাচি লেখক গত দুই বছরে একটাও নতুন লেখা লিখতে পারেন নি। মাঝখানে চেষ্টা করেছিলেন আত্মহত্যা করতে। কিন্তু সাহসের অভাবে তিনি সেটা করতে পারেন নি। তাছাড়া মাথায় কত কত গল্প ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেগুলো না লিখে তিনি কীভাবে মারা যাবেন? এই সময় হঠাৎ একদিন পারুল বানুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছিলো। সিরিয়ালও পারুল বানু-ই দিয়েছিলো। সে সাথে এসেছে প্রহরি হিসেবে। সিরিয়ালের অপেক্ষায় বসে আছে তারা দু’জন আরও অনেকের সাথে। এই সময় ডাক্তারের সহকারিটা খড়খড়ে গলায় চিৎকার করে উঠলো- মিসেস মেহমুদ আছেন? পারুল বানু হাত তুলে তাকাতেই এডেনডেন্ট বললেন- ভেতরের রোগী বের হলে আপনি ঢুকবেন। পারুল বানু হ্যাঁসূচক মাথা নেড়ে বসে রইলেন। আর তাজ্জব হয়ে গেলেন এক সময়ের জনপ্রিয় লেখক মুবিন মেহমুদ।
ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে আরও একবার চমকালেন লেখক সাহেব। গাইনি ডাক্তার পারুলকে নাম জিজ্ঞেস করতে, মুবিন মেহমদু কিছু বলার আগেই, পারুল বললেন, পারুল মেহমুদ। আপা, এম-এর পর দুইটা ও দিয়েন। আমার স্বামী দুইটা ও দিয়েই লিখেন। ডাক্তার প্যাডে খস খস করে নাম, বয়স, ওজন লিখলেন। তারপর পাশের বিছানায় শুইয়ে রক্তচাপ দেখলেন, চোখ দেখলেন, পালস দেখলেন। তারপর ফিরে এসে টুকটাক প্রশ্ন করলেন পারুল বানুকে।
মুবিন মেহমুদের দিকে ফিরে বললেন, সম্ভবত আপনার স্ত্রী গর্ভবতী। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইউরিন টেস্টটা করিয়ে নিন। নিজেরাই বুঝতে পারবেন। পজেটিভ হলে পনেরো দিন পর আসবেন। আর নেগেটিভ হলে সাথে সাথে আসবেন আমার কাছে।
ছয়।
সেদিনই সন্ধ্যায় মুবিন মেহমুদ অনেক দিন পর কম্পিউটার খুলে লিখতে বসলেন। তবে অন্যদিনের মতো কীবোর্ড নিয়ে বসে থাকলেন না। বৃষ্টির ফোটার মতো তার আঙুলগুলো ঝড় তুলে চলেছে কীবোর্ডে। হঠাৎ কাঁধে স্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরে দেখলেন তার সদ্য অর্জিত সম্পদ পারুল মেহমুদ দাঁড়িয়ে আছেন।
কীবোর্ড থেকে হাত তুলে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। মুখে চওড়া হাসি টেনে বললেন- আমার ছেলের নাম আমি ঠিক করে ফেলেছি। ওর নাম হবে অবনীল মেহমুদ।
আর মেয়ে হলে? পারুলের মুখ ফুটে কথাটা বেরিয়ে এলো।
না না, আমার মেয়ে হবে না। আমি চাই ছেলে সন্তান। ছেলেই হবে আমার। তারপর স্ত্রীর মুখের দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ থেমে গেলেন। পারুল মিটমিট করে হাসছেন। একটা দ্বিধাদ্বন্ধ এসে ভর করলো সব্যসাচি লেখক মুবিন মেহমুদের মাথায়। স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলেন, মেয়ে হবে?
কিছুক্ষণ মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে থাকলেন লেখকসাহেব। তারপর মাথা তুলে অনিশ্চিতভাবে বললেন, ঠিক আছে, মেয়ে হলে ওর নাম রাখবো সৃষ্টি মেহমুদ। ঠিক আছে? খুশি?
ক্লিষ্ট একটা হাসি বেরিয়ে এলো পারুল বানুর ঠোঁটের চিপা থেকে। পারুল বানু। নাকি পারুল মেহমুদ?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.