বরুণ ইউনুভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই ওর একটা সমস্যা। আশেপাশের বন্ধুদের কানে কানে কথা বলতে দেখলেই ওর মনটা খঁচ করে ওঠে। মনে হয় ওকে নিয়েই বুঝি কোনো বাজে মন্তব্য করছে। বরুণ নিজে নিজেই ভাবতে থাকে আর মনের কষ্ট দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ হয়ে বুকে বাজে।
অর্ষার প্রবলেমটা আবার অন্যরকম। তার বন্ধুদের সাথে কথা বলার সময় ফিস ফিস করে বলেন। তার কাছে জীবনের সব কথাই সিক্রেট মনে হয়। ফলে কারও সাথে কথা বলতে গেলেই- “এই শোন, কী হয়েছে জানিস-?” বলেই বন্ধুর কানের কাছে মুখ নিয়ে যায় আর ফিস ফিস করে কথা বলে। প্রথম প্রথম বন্ধুরা মনে করতো অর্ষা বোধহয় একজনের নামে আরেকজনের কাছে কুৎসা রটায়। কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারেন এটা তার একটা প্রবলেম।
আজমল সাহেব সরকারী চাকুরি করেন। অফিসের মিটিং-এর সময় তিনি মুখ বন্ধু অবস্থায় ভার হয়ে থাকতে পারেন না। কথা বলতেই হয়। তাই তিনি পাশের জনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলেন। আর এটা সবার কাছেই বিরক্তিকর মনে হয়। আকার-ইঙ্গিতে অনেকেই উনাকে এসব করতে নিষেধও করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। আজমল সাহেব এসবের ধার ধারেন না। তিনি তার অভ্যাস চালিয়ে যান।
ইনকার আগ্রহ তার বান্ধবীদের প্রেমিকদের নিয়ে। ভার্সিটির শেষ বর্ষে চলে এসেছেন। ত্ওা তার ছেলেমানুষী যায় না। বান্ধবীদের প্রেমিকরা কে কী করে? কার সাথে পরকীয়া করে? বারে যায় কিনা এসব তথ্যই ইনকার ঝুড়িতে ভর্তি। সবই যে সত্যি তা না। আর সেজন্যই মাঝে মাঝে ঝামেলা বাধে। দেখা যায় ইনকা তার কোনো বান্ধবীকে তার প্রেমিক নিয়ে বলছেন- রুমেল কিন্তু গতকাল রাতে বারে গিয়েছিলো। কিংবা রুমেলকে দেখলাম অন্য একটা মেয়ের সাথে গতকাল অমুক রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে। তখনই দেখা যায় রাজ্যের ঝামেলা বেধে যায়। ইনকা এতে বেশ মজা পান।
হোয়াট ইজ কানকথা?
অনেকভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায় ব্যাপারটাকে। সহজ বাংলায় কুৎসা রটানো। সহজ করে ব্যাখ্যা করলে ব্যাপারটা দাড়ায় এরকম- কারো অনুপস্থিতিতে তার ব্যাপারে অন্য একজনের কাছে নেগেটিভ কিছু বলায় হচ্ছে কানকথা। কানকথা ব্যাপারটা এমনই বিপদজনক যে, যার কাছে বলা হলো সে আবার এটা নিজের মতো সাজিয়ে, রঙ মাখিয়ে অন্য আর একজনের কাছে উপস্থাপন করেন। আর এটাই হলো মারাত্মক ক্ষতিকর।
কানকথা বিপদজনক?
অবশ্যই। দেখা গেছে কানকথার উপর নির্ভর করে অনেকে আত্মহত্যার মতো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন। কারও সংসার ভেঙে যায়। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, ভালোবাসা-প্রেম, ভালো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় অতি সহজে। সুতরাং এটা যে মারাত্মক বিপদজনক এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
কীভাবে কানকথা বিপদজনক?
বিশজনের একটা মিটিং রুম। কান কথা ব্যাপারটা ব্যাখা করার জন্য একজন টিচার প্রথম জনের কানে কানে একটা কথা বললেন। এবং তাকে বললেন পরের জনের কাছে কথাটা কানে কানে বলতে। এভাবে বিশজনের কাছে কথাটা বলার পর বিশতম ব্যক্তিকে বললেন জোরে জোরে কথাটা বলার জন্য। দেখা গেলো প্রথমজনকে যা বলা হয়েছে সেই কথা আমুল পরিবর্তন হয়ে গেছে বিশতম ব্যক্তির কাছে গিয়ে। এই পরীক্ষাটা আপনিও করতে পারেন আপনার বন্ধুদের নিয়ে। অবাক এবং বিস্মিত হবেন নিঃসন্দেহে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেনÑ কানকথা কোনো কথা নয়। তাই কানকথায় নয়, বরং যে কানকথা বলে তাকেও এভয়েড করা উচিত। আর একটা ব্যাপার- যিনি কানকথা বলেন এবং যিনি কানকথা শুনেন, গুরুত্ব দেন দু’জনই সমান দোষী। কারন যার সাথে আপনার সম্পর্ক অনেকদিনের, তার অনুপস্থিতিতে তৃতীয় একজনের কথা শুনে আপনি কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার এতোদিনের সম্পর্কের একজনের সাথে? এটা তো আপনার-ই ভুল।
কানকথায় কান নয়
ইয়েস! কানকথায় কান দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আপনি যাকে ভালোবাসেন তার কথা এবং কাজের প্রতিই আপনাকে আস্থা রাখতে হবে। তৃতীয় কারও কথায় নয়। কানকথা যেমন কথা নয়, তেমনি কানকথায় কান দেয়াও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আপনার সঙ্গী কিংবা সঙ্গীনির প্রতি আপনার কোনো সংন্দেহ তৈরি হলে তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে নিন। অযথা অন্যকারও কথায় মাতবেন না। এতে সম্পর্কের মাঝে আড়াল তৈরি হয়। আর সম্পর্কে আড়াল তৈরি হলে সম্পর্কটা দ্রুত ভেঙ্গে যায়। সুতরাং এমন কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকুন যেনো আপনার সঙ্গী কিংবা সঙ্গীনির প্রতি আপনার আস্থার অভাব তৈরি হয়।
কেন হয় কানকথা?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সাধারণত ঈর্ষা, হিংসা, অহংকার থেকেই কানকথার ব্যাপারটা তৈরি হয়। হয়তো আপনি দেখবেন যে আপনাকে কানকথা বলছে সে আপনার শুভাকাঙ্খী। কিন্তু আদতে তা নয়। কানকথা বলা ব্যক্তি কখনোই ভালো নয়। এটা তার স্বভাব। ধরুণ কেউ একজন বললেন- “তোমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখলাম অমুক ছেলের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।” তাহলে ধরে নিনÑ আপনাদের দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে সে ঈর্ষান্বিত। তাই সে চাচ্ছে আপনাদের মাঝের সম্পর্কটা নষ্ট করতে। হুম, এটা ঠিক, আপনার গার্লফ্রেন্ড অন্যজনের সাথে কথা বলতেই পারে। কিন্তু সেই কথা বলা মানেই অন্যকিছু নয়। হয়তো এটা দরকারী কোনো কিছুই হতে পারে। কিন্তু সেই ছেলেটাও হয়তো কানকথাই বলছে আপনার গার্লফ্রেন্ডকে আপনার বিরুদ্ধে। সুতরাং ব্যাপারটাতে শিউর না হয়ে কোনোরকম অ্যাকশানে যাওয়া ঠিক নয়।
কানকথা কথা নয়
সবচেয়ে উত্তম হলো- কানকথাকে কথা হিসেবে গুরুত্ব না দেয়া। অন্যের কানকথা শুনতে যাবেন না। এবং নিজেও কানকথা বলা থেকে বিরত থাকুন। আর সঙ্গী কিংবা সঙ্গীনীর প্রতি আস্থা রাখুন, বিশ্বাস রাখুন।
***
লেখাটি সর্বপ্রথম প্রকাশ: দৈনিক সমকাল। তারিখ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.