রিয়াজুল আলম অন্তু ইউনিভার্সিটিতে পড়েন দ্বিতীয় বর্ষে। ক্লাসমেট হৃদিকে খুব ভালো লাগে তার। ভালোবাসার কথা জানাতে পারেন না কিছুতেই; সঙ্কোচ তাকে ঘিরে ধরে। এই দুরবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করলেন সহপাঠী-বন্ধু এলাহি। বুদ্ধি দিলেন- তুই ফেসবুকে একটা মেসেজ দে হৃদিকে। কিন্তু অবাক হলেও সত্যি অন্তুর কোনো ফেসবুক আইডি তখন ছিলো না। কিন্তু বন্ধুকে লজ্জায় সেটা না বলে সেদিনই সাইফার ক্যাফেতে বসে নিজের জন্য একটা ফেসবুক আইডি ওপেন করলেন অন্তু। ক্লাসের বন্ধুদের লিস্ট ধরে হৃদির প্রোফাইল আইডি খোঁজে পেলেন অন্তু। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন। অবাক করা ব্যাপার- হৃদি সাথে সাথে একসেপ্ট করে নিলেন সেই রিকোয়েস্ট। অবাক হলেও বুঝতে পেরেছিলেন হৃদি তার স্মার্টফোনে ফেসবুকে একটিভ ছিলেন বলেই সাথে সাথে সারা দিতে পেরেছিলেন।
সুতরাং অন্তুও তাই করলেন। নিজের স্মার্ট ফোনে একটিভ করলেন ফেসবুক। শুরু হলো তাদের অনলাইন পথ চলা। মেসেজ লেনদেন হয়েছে তাদের অনেক। কিন্তু তোমাকে ভালো লাগে, তোমাকে ভালোবাসি একথা কেউ কখনো বলেননি। তবুও তারা জানেন তারা পরস্পরকে কতই না ভালোবাসেন।
কাহিনীকা দুই
রুবেল পড়াশোনা শেষ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মনের মতো জব এখনো পাননি। খোঁজেই চলেছেন। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিসিএস; সব পরীক্ষাতেই অংশ নেন। ফলে প্রতি মাসে বইপত্র কিনতে কিনতে প্রায় ফতুর। হঠাৎ সেদিন এক বন্ধু বললেন- আরে বোকা! তুই এখনো বই কিনে পড়িস নাকি? তাহলে ফেসবুক আছে কী করতে? শুনেতো রুবেল আকাশ থেকে পড়লেন? বলে কি! সেতো জানে ফেসবুক হচ্ছে সময় নষ্ট করার একটা জায়গা। বন্ধুর কথা শোনে তার আগ্রহ বাড়লো। লজ্জার মাথা খেয়ে বন্ধুকে অনুরোধ করলেন বিস্তারিত বলতে। বন্ধুটি তাকে খোঁজ দিলো এক অজানা অধ্যায়ের।
এ এক এলাহি কাণ্ড! ফেসবুকে রয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ, ফ্যানপেজ। যেখানে বিসিএস ক্যাডারের মতো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্যও ফ্রিতে কোচিং দেয়া হচ্ছে। আপটুডেট তথ্য পাচ্ছে সে এখানে। কোনো একটা বিষয় না বুঝলে প্রশ্ন করতে পারছে। আবার উত্তরও পেয়ে যাচ্ছে প্রায় সাথে সাথেই।
কাহিনীকা তিন
অরবিন্দ কলেজে পড়েন। পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে তার একটাই হবি- গেমস খেলা। আজকাল আর অফলাইনে গেমস খেলে মজা পান না। ফলে ফেসবুকের মাধ্যমে দূরের বন্ধুদের সাথে অনলাইন গেমে মেতে উঠেন তিনি। সে এক অসাধারণ জগৎ।
কাহিনীকা চার
আলিভার ক্রিয়েটিভি গুণ দেখে বন্ধুরা তাক লেগে যান। তার হাতের ডিজাইন কিংবা ছোট্ট যেকোনো একটা কাজই সে চমৎকার নিপুণভাবে করতে পারে দক্ষতার সাথে। তারই ধারাবাহিকতায় সে কম্পিউটারে শিখলো এডোবি ফটোশপ। একদিন কী মনে করে তার ফেসবুকের কভার ফটোটা চমৎকার একটা ডিজাইন করলো। ঝুলিয়ে দিলো সেটা নিজের প্রোফাইলের কভার ফটো হিসেবে।
সেই কভার ফটো দেখে মুগ্ধ হলেন তার ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা যুক্তরাস্ট্রের সিনথিয়া কার্টার। আলিভাকে অনুরোধ করলেন তাকেও একটা সুন্দর কভার ফটো ডিজাইন করে দিতে। হাতে সময় ছিলো যথেষ্ট। মনোযোগ দিয়ে কাজ করে দিলেন আলিভা নিজের সবটুকু ক্রিয়েটিভিটি কাজে লাগিয়ে। সেই কভার ফটো দেখে সিনথিয়া কার্টার মুগ্ধ। ভূয়সী প্রশংসা করলেন আলিভার। আর আলিভাকে অনুরোধ করলেন একটা পেপাল একাউন্ট এড্রেস দিতে। কেন সেটা আলিভা বুঝতে পারেননি। তাছাড়া তার নিজের ছিলোও না। কিন্তু সিনথিয়ার বারবার অনুরোধে আলিভা তার এক বন্ধুর পেপাল আইডি দিলো। সেই বন্ধুটি কিছুক্ষণ পর জানালেন সেখানে আলিভাকে সিনথিয়া কার্টার নামের একজন পঁচিশ ডলার সেন্ড করেছেন।
শুনেতো আলিভা অবাক হয়ে গেলেন। এইটুকু কাজের জন্য পঁচিশ ডলার?!! তাও আলিভা কোনোরকম টাকার আশা না করেই কাজটা করেছিলেন। এর কয়েকদিন পর সিনথিয়ার কাছ থেকে তার এক বন্ধুর ফেসবুক কভার ফটো ডিজাইন করার অনুরোধ পেলেন আলিভা। পেমেন্টও পেলেন। এভাবেই শুরুা হলো আলিভার পথযাত্রা। এখন আলিভা একজন রিনাউন ফ্রিল্যান্স ডিজাইনার।
কাহিনীকা পাঁচ
ব্যাপারটা কষ্টকর হলেও সত্যি যে, কার অ্যাক্সিডেন্টে আবিদের বড় বোন হাসপাতালে। রাত তিনটার সময় ডাক্তার বলললেন রক্ত লাগবে জরুরি ভিত্তিতে। কিন্তু হাসপাতালে নেই ঐ গ্রুপের রক্ত। এখন কী করবেন আবিদ? কোথায় যাবেন? কাকে ফোন করবেন? কাউকে পেলেও তার আবার আসতে কতক্ষণ লাগবে?
হঠাৎ বুদ্ধি খেলে যায় আবিদের মাথায়। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে নিজের ফেসবুক একাউন্টে লগিন করেন আবিদ। তারপর খুঁজে পেতে বের করেন একটা স্বেচ্ছাসেবী রক্ত ডোনেট করে এরকম ফ্যানপেজ। রক্তের গ্রুপ উল্লেখ করে পোস্ট দেন ওখানে জরুরি রক্ত চেয়ে। মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে আবিদের খবর পৌঁছে যায় সর্বত্র। আর আধা ঘণ্টার মধ্যেই আবিদের বোনকে রক্ত দেয়ার জন্য হাসপাতালে চলে আসেন তিনজন ব্লাড ডোনার। আহ! কী শান্তি যে লাগে আবিদের।
ফেসবুক কী এবং কেন?
যদিও ফেসবুক মাত্র একটি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট। কিন্তু এখন এর ব্যপ্তি-পরিধি এতো বিশাল যে বলে শেষ করা যাবে না। কী নেই ফেসবুক কেন্দ্রিক? সময়ের অপচয় থেকে শুরু করে লক্ষ-কোটি ডলারের বিজনেস চলে ফেসবুককে কেন্দ্র করে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- ছুরি দিয়ে আপেলও কাটা যায় আবার মানুষও খুন করা যায়।
সত্যিই তাই। ফেসবুক এখন আর শুধু সামাজিক ক্ষেত্র নয়। এটা কারও জন্য আশির্বাদ আবার কারও জন্য অভিশাপ।
কীভাবে ফেসবুক ব্যবহার করবো?
এটা সম্পূর্ণই আপনার ব্যাপার। আপনার প্রয়োজনটা হলো বড় এখানে। কেউ সময় নষ্ট করে বন্ধুদের সাথে সাধারণ বিষয়ে কিছু চ্যাট করে। আবার কেউ সেই সময়টাকেই কাজে লাগায় পড়ালেখা বা কোনো কাজের কথায় চ্যাট করে। অথচ দেখুন এই দুয়ের মাঝে কত ব্যবধান। ফেসবুক হলো এরকম একটি ক্ষেত্র যেখান থেকে আপনি যা চান তা-ই সংগ্রহ করতে পারবেন।
ফেসবুক আইডিয়া
ধরুন আপনি এখন পড়ালেখা করছেন। ভবিষ্যতে ই-কমার্স ব্যবসা করবেন। ধরে নিলাম আপনার প্রোডাক্ট হচ্ছে ঘড়ি। তাহলে আপনি ঘড়ি নিয়ে একটা ফেসবুক ফ্যানপেজ বানান। সেখানে কেনাবেচার কথা কিছুই না লিখে ঘড়ি নিয়ে পৃথিবীতে যতো মজার, জ্ঞানী, ফানি তথ্য আছে সেগুলো পোস্ট করুন স্ট্যাটাস আকারে। এভাবে প্রতিদিন যদি আপনি পোস্ট করেন দেখবেন ছয় মাস, এক বছরের মধ্যে আপনার এই ঘড়ি নিয়ে করা ফেসবুক ফ্যানপেজের ফ্যান সংখ্যা হয়েছে লক্ষাধিক। এদের সবারই কিন্তু ঘড়ি নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। তার মানে বুঝতে পারছেন?
মানে হলো এরা সবাই-ই ঘড়ির সম্ভাব্য ক্রেতা। এরা এতোদিন আপনার সাথে ছিলো। আপনার ঘড়ি বিষয়ক স্ট্যাটাস, পোস্ট, নোটগুলো পড়ে তারা উপকৃত হয়েছে, মজা পেয়েছে, তথ্য পেয়েছে। মানে এদের সবার আস্থা আপনার দিকে কিছুটা হলেও আছে।
এবার যদি আপনি ওদের বলেন যে আপনি ঘড়ির বিজনেস করতে চাচ্ছেন, দেখবেন সবাই-ই আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছে। এর ২/৩ পার্সেন্টও যদি আপনার ক্রেতা হয় তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় ভাবুন একবার।
সমাপ্তিকথন
আগেও বলেছি, উদাহরণ দিয়েছি এবং এখনো বলছি- ফেসবুক হলো এমন একটা ক্ষেত্র যেখানে ভালো-মন্দ, অপ্রয়োজনীয়-প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে। বাট কোনটা আপনি নেবেন সেই দায়িত্ব সম্পূর্ণই একান্ত আপনার। তবে আমাদের শুভকামনা এবং চাওয়া আপনি ভালোর সাথেই থাকুন। ফেসবুক আপনার ভালো কাজের সঙ্গী হয়েই থাকুক সর্বদা। শুভকামনা অল দ্য টাইম।
লেখাটি সর্বপ্রথম প্রকাশ: দৈনিক সমকাল। তারিখ: ৮ ডিসেম্বর ২০১৩
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.