ডিজিটালয়নের যুগে বর্তমান সময়ে অনলাইনে কেনাকাটার চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে এই সেক্টরেও ভালো মানের ক্যারিয়ার তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে যারা চাকরি করার চেয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত করতে চান তাদের জন্য অনলাইন শপে ক্যারিয়ার চমৎকার একটি দৃষ্টান্ত। কেন?
অন্যান্য বিজনেসের চেয়ে অনলাইন শপে ক্যারিয়ার করতে তুলনামূলক ইনভেস্ট কম লাগে। যৌথভাবে খুব সহজে শুরু করা যায়। ফিজিক্যাল প্রোডাক্টের পাশাপাশি ডিজিটাল প্রোডাক্টও কেনাবেচা করা যায়। সহজে পেমেন্ট পাওয়া যায় আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো- এখানে বাকী দিয়ে লস খাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। তো এই কারণে আমরা আজকে অনলাইন শপ নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার আদ্যপ্রান্ত জেনে নিতে চাই।
শুরুতেই সতর্কীকরণ!
আপনি কি জানেন কেন আপনি অনলাইন শপ করতে চান? কেন এই পেশায় নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চান? যদি জেনে থাকেন ভালো এবং সেটাকে আরও ভালোভাবে জাস্টিফাই করে নিন। আর যদি এই ব্যাপারে কিছুই না জেনে থাকেন কিন্তু আগ্রহ থাকে প্রচুর তাহলে জেনে নিন এই ব্যাপারে বিশদ। তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
শুরু কীভাবে?
ঠিক কোথায় থেকে শুরু করবেন? এই প্রশ্নটার জবাব সবার আগে জেনে নেয়া আবশ্যক। কাজ শুরু করার আগে অবশ্যই আপনার ধারণা থাকতে হবে অনলাইন শপ সম্পর্কে, অনলাইন বা ই-কমার্স বিজনেস সম্পর্কে। তাহলে নিজেই বুঝতে পারবেন ঠিক কীভাবে আর কখন শুরু করবেন? কী দিয়ে শুরু করবেন? এই জন্য আপনি প্রথমেই অনলাইনের দ্বারস্থ হোন। কিংবা কোনো উদ্যোক্তার পরামর্শ নিতে পারেন। বর্তমানে বিভিন্ন এনজিও, উদ্যোক্তা ফ্যামিলি অনলাইন শপ ক্যারিয়ারের উপর শর্ট ওয়ার্কশপ করিয়ে থাকেন। সেগুলোতে যেতে পারেন। সফল উদ্যোক্তাদের লেখা কিছু বই পড়া আবশ্যক। পড়তে পারেন চেতন ভগতের ফিকশনগুলো। এভাবে নিজের মস্তিষ্কে অনলাইন শপ বা ই-কমার্স বিজনেস সম্পর্কে তথ্য লোড করুন। দেখবেন ঐসব তথ্যভা-ার থেকে সহজেই একটা মডেল দাঁড়া করাতে পারছেন আপনি।
অনলাইন শপ প্ল্যান
অনলাইন শপ বা ই-কমার্স সম্পর্কে যখন মোটামুটি তথ্য আপনি গেদার করবেন তখন আপনাকে সুন্দর একটা প্ল্যান তৈরি করতে হবে। এই প্ল্যানটাই হলো আপনার মূল বিষয়। প্ল্যান যতো সুন্দর হবে, আপনার অনলাইন শপ ততই সফলতার মুখ দেখবে। সুতরাং সুন্দর এবং কার্যকরী একটি পরিকল্পনা মানেই আপনার বিজনেসের সত্তর ভাগ কাজ কমপ্লিট বলা যায়। প্ল্যানটা তিন ভাগে ভাগ করে নিতে পারেন এভাবে-
- প্রাইমারী স্টেজ: এই স্টেজে অনলাইন শপ সম্পর্কে জানাশোনা, পড়ালেখা অর্থাৎ নলেজ গেদার করার ব্যাপার থাকবে এই অংশে। এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার- প্রোডাক্ট বাছাই। অর্থাৎ আপনি কোন ধরণের প্রোডাক্ট নিয়ে অনলাইন শপ করতে চান সে প্রোডাক্টটি বাছাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- সেকেন্ডারি স্টেজ: এই স্টেজে আপনার অনলাইন শপের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা, সাজানো এবং রেডি করে পরিবেশন করার দায়িত্ব থাকবে। যেমন- অনলাইন শপের জন্য মূল দরকারী ব্যাপার হচ্ছে, একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট। যেখানে আপনার প্রোডাক্টগুলো শোকেস আকারে প্রদর্শিত হবে যাবতীয় তথ্যসহ। যেমন- প্রোডাক্টের ডাইমেনশনাল ছবি, প্রোডাক্টের দাম, প্রোডাক্টের বর্ণনা, ডেলিভারি মেথড, পেমেন্ট মেথড, ওয়ারেন্টি/গ্যারান্টিসহ আরও বেশ কিছু তথ্য ইনপুট করা হয়। আর ওয়েবসাইট তৈরিতে আপনাকে কিনতে হবে ডোমেইন-হোস্টিং এবং ওয়েবসাইট ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্টও এই স্টেজের অন্তর্ভুক্ত।
- ফাইনাল স্টেজ: আপনার প্রোডাক্টসহ আপনার অনলাইন শপ এখন রেডি। বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনে সংযোগের মাধ্যমে আপনার অনলাইন শপ যে কেউ দেখতে পারবেন। যদি ইন্টারন্যাশনাল ডেলিভারি সিস্টেম থাকে তাহলে দেশের বাইরে থেকেও কেনাকাটা করতে পারবেন আপনার ওয়েবসাইট থেকে। আর এই স্টেজের মূল ব্যাপার হচ্ছে- মার্কেটিং। আপনার অনলাইন শপের প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। সেক্ষেত্রে অফলাইনের চেয়ে অনলাইন মার্কেটিং-এর গুরুত্ব বেশি হওয়া আবশ্যক। কারণ আপনি আপনার পণ্য বিক্রি করছেন অনলাইনে। আপনার ক্রেতাদের টার্গেট অডিয়েন্স আগে চিনতে হবে তাহলে মার্কেটিং-এ হবে সুবিধা।
অনলাইন শপ বাস্তবায়ন
ইতোমধ্যে আপনি আপনার অনলাইন শপের বাস্তবায়নের অনেক কাজই করে ফেলেছেন। এখন সেটাকে পরিপূর্ণতা দান করতে দরকার আরও কিছু সিদ্ধান্ত এবং সেসব সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। যদি সঠিকভাবে সেগুলো করতে পারেন তাহলেই আপনার অনলাইন শপ হবে টপ অব দ্য মার্কেট। কীভাবে সেগুলো করবেন? একটি অনলাইন শপকে বাস্তবে পরিপূর্ণ রূপদানের জন্য প্রয়োজন সঠিক মার্কেটিং পলিসি এবং আপনার ক্রেতাদের অবস্থান নির্ণয় করা। ক্রেতাদের অডিয়েন্স যদি টার্গেট করতে পারেন সফলভাবে তাহলে আপনাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও চিন্তা করতে হবে না আর। এছাড়াও যে বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখতে হবে সেগুলো হচ্ছে-
- অনলাইন শপের নাম: ব্রান্ডিং একটি কঠিন ব্যাপার। ব্রান্ডিং-এর শুরুতে যেটা করতে পারেন সেটা হচ্ছে- সুন্দর এবং অর্থবোধকভাবে আপনার অনলাইন শপের নামকরণ করা। কারণ অনলাইন শপের নামেই আপনার ওয়েবসাইটের নামটি হবে। এই ক্ষেত্রে- ছোট, সহজে মনে রাখা যায় এরকম নাম হলে ভালো হয়।
- পেমেন্ট মেথড: বাংলাদেশের মার্কেট যদি হয় আপনার মূল টার্গেট তাহলে শুরুতেই যে ধাক্কাটা আপনাকে সামলাতে হবে সেটা হচ্ছে পেমেন্ট মেথড নিয়ে। অযথা অনেকগুলো পেমেন্ট মেথড না এড করে প্রয়োজনীয় ২-৩টা পেমেন্ট মেথড এড করুন। এই ক্ষেত্রে থার্ড পার্টির সহযোগিতা নিতে পারেন অথবা সরাসরি পেমেন্ট মেথডও এড করতে পারেন। তবে যদি আপনার অনলাইন শপ শুরুতেই হুমকির সম্মুখীন না করতে চান তাহলে খরচ বেশি হলেও থার্ড পার্টির সহযোগিতা নেয়াই ভালো মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
- ডেলিভারি মেথড: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ডেলিভারি মেথড। ক্রেতাকে কত দ্রুত এবং কত সহজে আপনার প্রোডাক্ট পৌঁছুতে পারছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বর্তমানে অনেকেই ক্যাশ অন ডেলিভারি মেথড ব্যবহার করেন। অর্থাৎ ক্রেতা যখন প্রোডাক্ট গ্রহণ করবেন তখনই পেমেন্ট দেবেন। এক্ষেত্রে নিজস্ব ডেলিভারিম্যান দিয়ে ডেলিভারি দেয়া যেতে পারে কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসগুলো কন্ডিশনে আপনার প্রোডাক্ট বুকিং নেবে। অর্থাৎ ক্রেতা যখন প্রোডাক্ট রিসিভ করবে তখন পেমেন্ট দেবে। তাছাড়া যদি অগ্রিম পেমেন্ট নেন তাহলে কন্ডিশন ছাড়াই প্রোডাক্ট পাঠাতে পারেন।
ইনভেস্টমেন্ট
অনলাইন শপে ক্যারিয়ার দাঁড়া করাতে কী পরিমাণ ইনভেস্টমেন্ট আবশ্যক? এর সঠিক কোনো লিমিট বা এই ধরণের কিছু নেই। এটা নির্ভর করছে আপনার উপর। খরচগুলো কোন কোন খাতে হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আলাপ করা যাক-
- মার্কেট রিসার্চ বা সার্চ ইঞ্জিনে প্রোডাক্ট বাছাই, প্রোডাক্ট বাছাই, জানাশোনা ইত্যাদি বাবদ ২০ হাজার টাকা।
- ডোমেইন বাৎসরিক এক হাজার টাকা।
- হোস্টিং শুরুতেই শেয়ার্ড নিয়ে শুরু করলে বাৎসরিক ২-১০ হাজার টাকা।
- ওয়েবসাইট ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্ট বাবদ ১৫ হাজার থেকে ৫ লক্ষ টাকা।
- এসইও বা মার্কেটিং বাবদ প্রতি মাসে ৫-১০ হাজার টাকা।
- আর বাকী থাকলো প্রোডাক্ট। প্রোডাক্ট যদি নিজে তৈরি করেন তাহলে আপনার প্রোডাক্টের উপর নির্ভর করে খরচ হবে। আর যদি কোনো উৎপাদনক্ষম কোম্পানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তাহলে সেক্ষেত্রে কম হবে। শুরুতে সবাই যেটা করে সেটা হচ্ছে- নিজের অনলাইন শপের নামে ট্যাগ তৈরি করে আর হোয়াইট লেবেল প্রোডাক্ট কিনে ট্যাগ লাগিয়ে নেয়। এতে খরচ তুলনামূলক কম।
অন্যান্য ব্যাপার
অনলাইন শপে ক্যারিয়ার অবশ্যই সুন্দর এবং স্মার্ট একটি ওয়ে। যদি সঠিক পরিকল্পনা করে শুরু করতে পারেন তাহলে কোনোরকম হুমকি ছাড়াই এই বিজনেসে ভালো করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- অনলাইনে মানুষ দিন দিন নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। অর্থাৎ এই মার্কেটের পরিধি দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই সম্ভাবনাও বেশি। দেরি না করে কাজ শুরু করুন আজই। আপনার অনলাইন ক্যারিয়ার হোক শুভ।
রুহুল আমিন says
ধন্যবাদ। আপনার এই লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। অনলাইন শপ খুলতে অনুপ্রাণিত হলাম।