গল্পের শুরুটা হয়েছে নারগিস জীবনে প্রথম ছ্যাঁকা খাওয়ার মধ্য দিয়ে। ঠিক এভাবে এসেছে বইয়ে-
নারগিস বলল, দোস্ত আমি তো ছ্যাঁকা খাইছি, কী হবে আমার?
আমি একটু অপ্রস্তুত, তাই বললাম, কী হবে আবার?
সে বলল, সেটাই তো, কী-ই বা হবে!
আমি বললাম, খুলে বল কী হইছে?
ও গোমড়া মুখটা আরো গোমড়া করে দ্রুত বলল, সেটাই তো, কিছুই হয় নাই। আমি ছ্যাঁকা খাইলাম কিন্তু দ্যাখ কিছুই হচ্ছে না। সবকিছু আগের মতন আছে। সূর্য উঠতেছে, চাঁদ জ্বলতেছে। আম্মা সকালবেলা ইসুবগুলের ভুষি খাইতেছে।
বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল নারগিস। চোখ কুঁচকায়ে, কপাল কুঁচকায়ে, শ্বাস টেনে একটা ভয়াবহ অবস্থা হইল। আর আমি কিছুই বুঝলাম না। মেয়ে ছ্যাঁকা খাইলে আম্মা কেন ইসুবগুলের ভুষি খেতে পারবে না! এটাতে এমন দুঃখ পাওয়ার কী আছে?
আসলেই তাই, প্রেমে ছ্যাঁকা খেলে কেন দুঃখ পেতে হবে? এই সহজ বিষয়টা আভাস দিয়েই যেহেতু উপন্যাসের শুরু, আমার প্রচণ্ড আগ্রহ হলো লেখাটার প্রতি। চিন্তা করলাম পুরো লেখাটা পড়তেই হবে। আর কি কি সহজ বিষয় আছে সেটা জানার আকাঙ্খা আমাকে পেয়ে বসলো। ছ্যাঁকা খাওয়াতো অতো সহজ কথা না। ছ্যাঁকার পরবর্তী ধাপগুলোও কঠিনতর। নারগিসের এই সহজ স্বীকারোক্তিই দ্বন্ধ সৃষ্টি করে। বুঝতে চেষ্টা করি কেন? দুঃখে ভারাক্রান্ত? পাথর হৃদয়? শোকে মর্মাহত, চোখের পানি শুকিয়ে গেছে?
দুই.
পারমিতা হিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কবি ব্রাত্য রাইসু একুশে বইমেলায়। এর আগে ফেসবুক পর্যন্ত ছিলো জানাশোনা। আমি হিমকে আমার সম্পাদিত সাক্ষাৎকার পত্রিকা দিলাম। উল্টেপাল্টে দেখে বললেন- বাহ! এই, আপনি আমার প্রোগ্রামের লাইভে আসেন পত্রিকাটা নিয়া। শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর থেকে আমি পারমিতাকে দেখলেই পালিয়ে যাই।
যাহোক, অল্প দু’টি কথা বলে ভালো লাগলো। ফেসবুকের বাইরে, হিমের পরিপূর্ণ লেখা সম্ভবত প্রথম পড়ি সাহিত্য ডট কম পত্রিকায়। এরপর যখন যেখানে হিমের লেখা পাই পড়ি। ভালো লাগা থেকেই পড়া। কিন্তু হিম যে পুরো উপন্যাস লিখে ফেলেছেন এবং সেটার প্রকাশক ব্রাত্য রাইসু, ব্যাপারটা আশ্চর্যই। মূলত এই দু’টি কারণেই বইটা পড়ার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ তৈরি হয় আমার। এবং একটা ভালো উপন্যাস পড়ার অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু প্রকাশক এমন! বই সহজে বের করেন না। অবশ্য সেটা লেখকের খামখেয়ালিও হতে পারে।
এক নজরে…
বইয়ের নাম: নারগিসলেখক: পারমিতা হিম
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজুর রহমান
প্রকাশক: বহিঃপ্রকাশ
প্রকাশকাল: মার্চ ২০১৮ (বইয়ে লেখা- প্রথম সংস্করণ)
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২০৪
মূল্য: ৫০০ টাকা
সাইজ: ক্রাউন
ধরণ: উপন্যাস
তিন.
উপন্যাস হিসেবে “নারগিস” নামটা আমার পছন্দ ছিলো না বইটা না পড়া পর্যন্ত। মনে হচ্ছিলো- লেখকের প্রথম উপন্যাস। উচ্ছাস থেকেই বোধহয় নামটা এরকম রাখা হয়েছে। বইটা পড়ার পর মনে হয়েছে, নাম যথার্থ। বইটাকে তিনটা মূল অংশে ভাগ করা যায়-
- ইমম্যাচিউর
- প্রিম্যাচিউর
- ম্যাচিউরড
লেখার ধরন অনুযায়ী ভাগটা করিনি, গল্পের ধরণমতো হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে- একটা ভাগ থেকে অন্যভাগটাতে যাওয়ার সাথে সাথে লেখার ধাঁচও পরিবর্তন হয়েছে। অসম্ভব ভালো লেগেছে এই বিষয়টা। ক্লাস এইটে পড়ুয়া একটা মেয়ের ভাষার প্রকাশ যেমন হওয়া প্রয়োজন, হিম ইমম্যাচিউর অংশে ঠিক সেভাবেই প্রকাশ করেছেন। অদ্ভুতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ছেলেপনাটাকে ভাষার মাধ্যমে। সত্যিই সুন্দর।
ইমম্যাচিউর থেকে প্রিম্যাচিউরে প্রবেশটা ক্লিয়ার বুঝা যায়, যদিও প্রিম্যাচিউর থেকে ম্যাচিউরড অংশে প্রবেশ অতোটা স্পষ্ট না। আবার এমনও মনে হয়েছে- ম্যাচিউরিটিটা বুঝাতেই হয়তো এভাবে করা হয়েছে।
কী আছে নারগিস উপন্যাসে?
নারগিসের আব্বা বিদেশ থাকে। নারগিসের আম্মা সুন্দরী। পরকিয়া করে এক আর্মি অফিসারের সাথে। নারগিস হলো এরকম- “ফিগার দেখানোর যথেষ্ট চেষ্টা আছে, কিন্তু উগ্রতা নাই”। এই নারগিসের বান্ধবী রোকসানার বয়ানে (অর্থাৎ উত্তম পুরুষে বলা) লেখাটা পড়ি আমরা। চট্টগ্রাম শহরে ওদের বাস। সেখান থেকে কীভাবে নারগিস চলে যায় আমেরিকায় আর বুয়েটে ভর্তি হয়ে ঢাকায় চলে আসে রোকসানা সেটাও জানা যায় উপন্যাস থেকে।
ক্লাস এইট পর্যন্ত সময়টাকেই “ইমম্যাচিউর” হিসেবে কাউন্ট করেছি। এই সময়টা পর্যন্ত উপন্যাসের গতিটা চমৎকার। বলার ধরণ এবং কাহিনীর অগ্রসরমানতা মেদহীন। এই সময়ের গল্পটা কিশোরী মনোভাব, চিন্তা-চেতনা, রাগ-অভিমান, হিসেব-নিকেশ ইত্যাদি বিষয়।
প্রিম্যাচিউর অংশটা হিসেব করেছি ক্লাস নাইন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষ পর্যন্ত সময়টাকে। এই সময়টার গল্পটা ভাঙ্গা-গড়নের। তাল-লয় যথেষ্ট আপ-ডাউন হয়েছে। কোথায় থেকে কোথায় গিয়ে গড়িয়েছে বা গড়াবে বুঝতে পাঠককে হিমশিম খেতে হয়। একজন লেখকের জন্য এই স্থানটা যথেষ্ট কঠিন। হিম সুন্দরভাবেই কাহিনী এগিয়ে নিয়ে গেছেন পরিণতির দিকে।
ম্যাচিউরড অংশটায় মূলত একজন নারীকে নারী হিসেবে টিকে থাকার প্রয়াস। এখানে হিম যতোটা পরিণত হয়েছেন, ঠিক ততোটাই গল্পটাকে একেবারে কেঁচে ফেলেছেন সমাপ্তিতে। খুবই সাধারণ, সাদামাটা এবং গতানুগতিক সমাপ্তি। পাঠক নিশ্চয় এরকম একটা পরিণতি আশা করেন নি। হয়তো ব্যাপারটা এমন- হিম ছোটগল্প ভেবেই গল্পটা শেষ করেছেন। কিংবা নাটকীয়তাতো আমাদের সবার মাঝেই বসত করেন। হিম কি তবে নিজের আবেগকে যথেষ্ট লাগাম টানতে পারেন নি নাকি হিম গল্পটা দ্রুত শেষ করার জন্যই এরকম একটা পরিণতি টেনে দিলেন?
তবে এ কথা ঠিক, হিম ম্যাচিউরড অংশে যা বলেছেন, মানে উপন্যাসের ভাষায় যা প্রকাশ করতে চেয়েছেন তা-ই যথেষ্ট ছিলো। টরেন্টো এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পাঠককে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার ছিলো ওরকম মামুলি একটা পরিণতি দেখানোর জন্য? হিথ্রোতেই থামতে পারতেন হিম।
যে কারণে নারগিস পড়বেন না!
আমার মনে হয়েছে পারমিতা হিমের উপন্যাসের মূল কথা হচ্ছে এই লেখাগুলো-
“এখানকার মেয়েদের তুমি চেনো না।…. তখনই তোমার জন্য কাঁদবে যখন তুমি হয় রেইপড, না হয় জামাই তোমারে পিটায়, না হয় কোনো না কোনোভাবে তুমি একজন লস্ট পার্সন। হেরে গেছো, তাই তোমার সাথে কাঁদবে। তোমার অধিকারের জন্য চেঁচাবে। কিন্তু তুমি আজকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে নিজের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে যাও- এরাই তোমাকে ছিঁড়ে ফেলবে। যে মেয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, স্বাধীনভাবে বাঁচে, কারো ধার ধারে না, এরা কোনোদিন তার পাশে দাঁড়ায় না। দাঁড়াবে না। তারা নিজেরা কোনো নারীর উন্নতি সহ্য করতে পারে না। পারবেও না। কীভাবে তাকে টেনে হিঁচড়ে নামানো যায় সে চিন্তাই করবে। এসব নারীবাদ ভুয়ার চেয়েও ভুয়া। হাতাকাটা ব্লাউজ পরলে আর ক্লিভেজ একটু বেশি দেখাইলেই নারীবাদ হয় না…। নারীবাদ হইল নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সেক্সুয়াল স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা।”
~ নারগিস / পারমিতা হিম, পৃষ্ঠা ১৮৪
সাধারণত আমাদের দেশের মানুষেরা এরকম বলা কথা সহজভাবে নেয়ার ক্ষমতা রাখেন না। নারীবাদ, নারী অধিকার, নারী সমঅধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো গুলিয়ে ফেলেন। নারীর পক্ষ নিলেই নারীবাদি হওয়া যায় না। নারীর পাশেও দাঁড়ানোর দরকার নেই। তার অধিকার সে ফলাতে গেলে সেখানে বাধা হয়ে না দাঁড়ানোটাই চাওয়া। উপরের লেখাগুলো পড়ুন, বারবার পড়ুন। তারপর চিন্তা করেন নারগিস পড়বেন কি পড়বেন না!
ভালো লেগেছে…
ভালো লেগেছে ভাষার সহজবোধ্যতা। অর্থাৎ বঙ্কিমের “যাহা পড়িবামাত্রই বুঝিতে পারা যায় উহাই উৎকৃষ্ট রচনা…” হিমের নারগিসে দেখেছি। সহজ করে বলাটা সত্যিই কঠিন। একজন লেখক যা ভাবেন তার সবটুকু লেখায় পরিণত করতে পারেন না। যিনি যতো কাছাকাছি পারেন তিনি ততই সফল লেখক। হিম অনেকটা পেরেছেন বলেই মনে হয়। ভাষার প্রাঞ্জলতা আছে তার লেখায়। অযথা তৎসম কঠিন শব্দ বসিয়ে লেখাকে ভাবগম্ভীর করে তুলেন নি। ভালো লেগেছে হিমের চিন্তার সুদূরপ্রসারী মনোভাব। ভাষার ব্যবহার। বাক্য গঠনের নিয়ন্ত্রণ, গল্পের মোড়।
ভালো লাগা আরও কিছু লাইন:
ভালো লেগেছে বইয়ের বাইন্ডিং, কাগজ, ছাপা। অসম্ভব ভালো হয়েছে বইয়ের কোয়ালিটি। বাংলাদেশের প্রচলিত বুক সাইজে করা হয়নি বইটি। ক্রাউন সাইজ করা হয়েছে। দূর থেকে যারা বইটির দাম বেশি বলছেন, বইয়ের মান দেখে সেটা বলবেন না। আর পড়া শেষ হলেতো আরও বলবেন না। নিশ্চিত।
বইয়ে বানান ভুল নেই বললেই হয়। এই বিষয়টা ভালো লেগেছে বেশি। ফন্ট সাইজ ঠিক আছে, লাইনের মাঝের স্পেস পর্যাপ্ত। পড়তে সুবিধা হয়েছে এতে।
ভালো লেগেছে বইয়ের প্রমোশনাল বিষয়গুলো। প্রকাশকের দায়িত্বজ্ঞান প্রশংসনীয়। বহিঃপ্রকাশ এক বই দিয়েই পাঠকের মনে এই আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যে, তাদের প্রকাশনার বইয়ের মান আস্থাশীল হতে পারে। এটা প্রকাশকের জন্য অবশ্যই পজেটিভ দিক।
ভালো লাগেনি…
প্রচ্ছদ অতোটা ভালো লাগেনি। “বায়োগ্রাফি অব নারগিস” বা “বায়োগ্রাফি অব পারমিতা হিম” টাইপ প্রচ্ছদ। তাছাড়া কভারে দেয়া মুখের ছবি এবং ব্যাকগ্রাউন্ড কালার/টেক্সার দু’টি মনে হচ্ছে আলাদা কেটে বসানো হয়েছে। প্রচ্ছদে আরও যত্নবান হওয়া সম্ভব ছিলো।
ভুল বানান কম চোখে পড়েছে। দুয়েকটা মার্ক করেছি এরকম:
আর লেখকের অবহেলার কারণে কিছু বাক্য নজরে পড়েছে যা অন্যভাবে হলে আরও হয়তো ভালো হতো। দুয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক- এক জায়গায় চার জোড়া চোখের কথা বলা হয়েছে। সম্ভবত ওটা হওয়ার কথা ছিলো চারটি চোখ বা দু’জোড়া চোখ। গেইটে “টোকা” দেয়ার পরিবর্তে “ধাক্কা” শব্দটি যায় ভালো। টোকা শব্দটা দরজার সাথে মানানসই।
যদিও এগুলোকে ঠিক ভুল বলা যায় না। হয়তো হিমের লেখার প্রতি আলাদা একটা আকাঙ্খা তৈরি হয়েছে বলেই এগুলোকে নেয়া সহজ হচ্ছে না।
সবিশেষ
সবিশেষ আর কী বলবো? দ্রুত পড়ে তারচেয়েও দ্রুত পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখলাম। প্রকাশক এবং লেখকের জন্য শুভকামনা। যারা এখনও নারগিস পড়েন নি, দ্রুত পড়ে নিতে পারেন। নারগিসের মাধ্যমে হিম পরবর্তী বইয়ের জন্য পাঠকের মাঝে আকাঙ্খা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। হিম, আপনি যথেষ্ট সুন্দর একটা গল্প বলতে পেরেছেন। আপনার হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
নীরব মাহমুদ says
এমন পৃষ্ঠার ছবিসহ দাগ কেটে তৈরী রিভিউ দেখা যায় না সাধারণত। মনোযোগী পাঠকের চিহ্ন ছড়ানো ছিলো রিভিউতে। “যে কারণে নারগিস পড়বেন না!” এই অংশের রিভিউ বক্তব্য ভালো লেগেছে। এমন করে নিজেও ভাবি বলেই হয়তো। সবমিলে ভালো 🙂 নারগিস পড়া যেতে পারে , ভাবছি। ধন্যবাদ!
মুকুল says
সুন্দর রিভিউ! সহমত মতামতের সাথে। সমাপ্তির টুইস্ট ভালো লাগেনি। আর অবাক হয়েছি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই রোকসানাদের সিমন দ্য বোভেয়ার পড়ে ফেলা দেখে!
Kajal says
Boita onek khujlam pelam nah kothaw, kew ki bolte paren boita kothay pabo