পহেলা বৈশাখের আগের দিনের রাতের এক ঘটনা নিয়ে লেখা বাপ্পী খানের থৃলার নিশাচর পড়ে শেষ করলাম মাত্র। মাত্র এক রাতের গল্প। কত কিছুই না ঘটে যায় এক রাতে! তাই ভাবলাম, পহেলা বৈশাখেই লিখে ফেলা যাক বইটার একটা রিভিউ।
তাই গল্পের রেশ মাথা থেকে কেটে যাওয়ার আগে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে বসেছি। নিশাচরকে একটু ব্যবচ্ছেদ করা যাক।
নিশাচর-এর শুরু:
খুবই সাদামাটাভাবে শুরু হয়েছে গল্প। কিন্তু কয়েকটা লাইন পড়লে সহজেই ধারণা করে নেয়া যায় ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। কিন্তু সেটা কিসের? আগ্রহ তৈরি হয়। বাপ্পী খান গল্পের শুরু করেছেন এভাবে-
এক কোণায় এক চিলতে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠতেই সে অন্ধকারটা সাময়িক দূর হলো বটে, কিন্তু পরক্ষনেই আরো গভীর অন্ধকার ঘনিয়ে এলো চারপাশে। দূরে কোথাও বজ্রপাতের শব্দ কানে যেতেই লোকটার নীরবতা ভাঙলো।
এতোটুকু পড়ে মনে একটু খটকা লাগে। পড়তে বসেছি থৃলার, কিন্তু ফ্লেভার পাচ্ছি রোমান্সের। কিন্তু পরের লাইনটা পড়েই খটকা দূর হয়ে যায়। প্রথম লাইন কয়টা এস্টাব্লিশড হয়ে যায়। বুঝতে পারা যায় আসলেই “অন্ধকার” ঘনীভূত হচ্ছে। আভাস পেতে শুরু করি অন্ধকার জগতের একজনের গল্প। বাপ্পী খান পাঠকের মনে খুব সূক্ষ্নভাবে পূর্বাভাস দিয়ে যান, অন্ধকার মানুষেরা জেগে উঠছে। সাবধান হওয়া প্রয়োজন। কোনো এক নিশাচর-এর সাবধান হওয়া খুব দরকার।
আসলেই কি সেরকম কিছু হতে যাচ্ছে? নাকি বাপ্পী খান আভাস দিয়ে পাঠককে আবারও রোমাঞ্চের পরিবর্তে রোমান্সে নিয়ে যাবেন? চলুন তবে জানা যাক।
দুই.
লেখক বাপ্পী খানের সাথে পরিচিত হই প্রিয় থৃলার লেখক, প্রিয় মানুষ মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ভাইয়ের মাধ্যমে। মাত্র অল্প কদিনের পরিচয়। তখন পর্যন্ত উনার লেখা পড়া হয়নি। লেখা পড়ার আগেই জেনে গেলাম মানুষ হিসেবে চমৎকার। কারণ ভালো মানুষ না হলে ভালো লেখক হওয়া প্রায় অসম্ভব। যাইহোক, আর তখন থেকেই উনার লেখা পড়ার অপেক্ষায় ছিলাম। বইটা বের হওয়ার আগে তাই কয়েকবারই বই লিখে শেষ করার তাগাদা ছিলো আমার। একুশে বইমেলায় প্রকাশের প্রথম দিনেই বইটি কিনেছিলাম। আর তখনও বইয়ের বাইন্ডিং শুকোয়নি। কিন্তু পড়া হচ্ছিলো না রিভিউ লেখার সময়াভাবে। পরে ভাবলাম, যেহেতু বইটা একটা বিশেষ দিন নিয়ে লেখা, তাহলে ওই দিনই পড়ি।
বইয়ের গল্প খুব সাদামাটাভাবে শুরু হলেও, কিছুক্ষণ পড়ার পরে আর সাদামাটা থাকে না। পাঠককে নড়েচড়ে বসতে হয়। আমি তাই করেছিলাম। নড়েচড়ে বসেই উত্তেজনা প্রশমন করেছিলাম। বই শেষ না করে রাতের খাবার খেতে কষ্ট হবে ভেবে বই শেষ করেই খেতে বসেছিলাম। এগুলো আসলে আমার নিজেকে প্রকাশ নয়, নিশাচর এগুলো আমার কাছে আদায় করে নিয়েছে। পরিসরে ছোট একটি বইয়ের আবদেন যথেষ্টই গ্রহণযোগ্য।
এক নজরে…
বইয়ের নাম: নিশাচরলেখক: বাপ্পী খান
প্রচ্ছদ: ডিলান
প্রকাশক: বাতিঘর প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১২
মূল্য: ১৪০ টাকা
ধরন: থৃলার
তিন.
থৃলারের নামানুসারে নিশাচর চমৎকার একটা বইয়ের নাম। পাঠককে আগ্রহী করে তুলে। আর বই পড়ার পর মনে হবে নামটা যথার্থই। আমার কাছেও তাই মনে হয়েছে। নামের ব্যাপারে তাই কোনো দ্বিমত হওয়ার সুযোগ নেই।
নিশাচর বইয়ের গল্পটাকে দুইটা মূল অংশে ভাগ করা যায়। যেমন-
- গল্পের প্লট সাজানো
- গল্পের পরিণতি
প্রথম অংশে বাপ্পী গল্পের চরিত্র, স্থান, কাল আর পাত্রগুলোকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বর্ণনা করে গেছেন। লুক! “বর্ণনা” করে গেছেন। পরিচয় করিয়ে দেন নি। এই বিষয়টি বেশ ভালো লেগেছে। শুরুর কয়েকটি অধ্যায় পড়লে পাঠক অবাক হবেন। আগের অধ্যায়ের সাথে পরের অধ্যায়টির রিলেশন ঠিক কিভাবে, কোথায় তা বুঝতে একটু চিন্তিত হতে হয়। কিন্তু পড়তে মন্দ লাগে না, পড়ে যাওয়া যায়। আর পড়ে গেলেই এক সময় গল্পটার অবয়ব স্পষ্ট হতে থাকে।
যখনই অবয়বটা স্পষ্ট হতে থাকে, পাঠকের মজা সেখানেই শুরু। উত্তেজনা, পড়ার আনন্দ তখন অনেক বেড়ে যায়। বাপ্পী খুবই সূক্ষ্নভাবে পাঠককে কিভাবে তার লেখায় আটকে রাখেন সেই দিকটা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারা যায়।
তবে এ কথা ঠিক, শুরুর অংশটা যেভাবে বাপ্পী খান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লিখেছেন, পরিণতিটা ওভাব হয়নি। মনে হলো গল্পটা অনেক বড় করতে গিয়ে হঠাৎ তাড়াহুড়োয় কাটছাট দিয়ে ছোট করে ফেলেছেন। যেমন বিশ নাম্বার অধ্যায়টা অসামঞ্জস্য লাগে। এটা কেন এভাবে এলো বুঝতে পারিনি। কিভাবে এলো, কোথায় গেলো?
কী আছে নিশাচর থৃলারে?
মাত্র এক রাতের গল্প নিশাচর। অদ্ভুত না? কিন্তু ভালো লাগার স্পষ্টতা, মুগ্ধতা বিরাজ করে লেখার ধরনে। গল্পটা এরকম- নাফিস একদিন রাতে আত্মহত্যা করতে যায় ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে। সে রাত ছিলো পহেলা বৈশাখের আগের রাত। আত্মহত্যা করতে গিয়ে দেখে ফেলে অন্ধকার এক বাড়িতে চারটি টিভি চ্যানেলের চারটি মাইক্রোবাস। পহেলা বৈশাখের আগের দিন তারা কী করছে গ্রীনরোডের এই অন্ধকার গলির চিপা এক বাড়িতে? সাংবাদিক নাফিসের মনে প্রশ্ন জাগে। আত্মহত্যার কাছে জয়ী হয় নিজের আগ্রহী মন। সিদ্ধান্ত নেয় জানতেই হবে ওখানে কী হচ্ছে?
পরদিন পহেলা বৈশাখ। পুলিশ, র্যাব, সোয়াট- কারও চোখেই ঘুম নেই। নববর্ষ উপলক্ষ্যে চারুকলায় আসছেন প্রধানমন্ত্রী। সাথে থাকবেন আমেরিকার রাষ্ট্রদূত। সুতরাং চারদিকে নিরাপত্তার চাদর বিছিয়ে দেয়া।
কিন্তু এতোসব থোরাই কেয়ার করে, টাইম বোম বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিকল্পনা করেছে একটা টেরোরিস্ট দল। যারা বছর দেড়েক আগে এরকম সেইম ঘটনা ঘটিয়ে অনেকজনের তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছিলো। এবার আরও সুপরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে কাজটা। এমন বিশেষ এক বোমা বহন করছে তারা যেটা কোনোরকম ডিটেক্টরেই ধরা পড়বে না।
চারুকলা, শাহবাগসহ আশেপাশে সর্বত্র সাজ সাজ রব। হাজার হাজার মানুষ আসছে মঙ্গলযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে। সূর্য়োদয়ের সাথে সাথে শুরু হবে অনুষ্ঠান আর অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নিজে।
কী হবে এবার? পূর্বাভাস আর শেষের গল্পসহ মোট ৩৭টা অধ্যায় রয়েছে নিশাচর বইটাতে। বিশেষ করে শেষের দিকে এসে উত্তেজনায় বারবার পাঠে বিঘ্ন ঘটে।
পারবে কি টেরোরিস্ট গ্রুপটাকে আটকাতে? নাকি তারা সফল হতে যাচ্ছে নাশকতার এই কাজে? হাজার হাজার নিষ্পাপ মানুষ কি মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে?
ভালো লেগেছে…
বাপ্পীর গল্প জমিয়ে তোলার ব্যাপারটা খুবই ভালো লেগেছে। পাঠক বই পড়ে আনন্দ পাবেন। একজন লেখকের এটাই বড় স্বার্থকতা। এদিক থেকে বাপ্পী খান নিশাচর দিয়ে যথেষ্ট স্বার্থক। বাক্যগঠন, গল্পের পরম্পরা ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে থৃলারের মধ্যে রোমান্সের বহিঃপ্রকাশ।
বইয়ের প্রচ্ছদ অসাধারণ। গল্পের কাহিনীর স্পষ্ট ছাপ পড়েছে বইয়ের প্রচ্ছদে। কাগজ, বাইন্ডিং আর ছাপার মানও যথেষ্ট ভালো। বইয়ের মূল্য অনেক কম। অবশ্য বাতিঘরের অন্যান্য বইয়ের মূল্যও কম রাখা হয়। তো এই দিকগুলো বেশ ভালো লেগেছে।
ভালো লাগেনি…
বইয়ে বানান ভুল কম। কিন্তু ফন্ট মিসটেক অনেক বেশি। সম্ভবত ফন্ট পরিবর্তন করা হয়েছে, তাই হয়েছে এই সমস্যা। যেমন হ্রস-ও কার, র-ফলা এ-কার ইত্যাদি জায়গামতো বসেনি। হয়তো আরেকটু ধীরে-সুস্থ্যে বইয়ের এই ভুলগুলো দেখার অবকাশ থাকতে পারতো। অবশ্য শুরুর দিকে এই ভুলগুলো যতোটা চোখে পড়ে, শেষ দিকে অতোটা নয়। এই দিকগুলো ঠিক হলে আরও ভালো লাগতো।
আর লেখকের গাফিলতির কারণে কিছু জায়গায় ভালো লাগেনি। কাজী নজরুল ইসলামের গানের দুই লাইন বইয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে ভুল। এরকম ভুল গ্রহণযোগ্য নয়।
লাইন দু’টি হবে:
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুন্তে পাই।।
সূত্র: নজরুল গীতি
লেখকের গাফিলতির কারণে আরও কিছু ভুল নজরে পড়েছে। সেগুলো তেমন ধর্তব্য নয়। তারপরও উল্লেখ করা যাক। কারণ একজন লেখককে সূক্ষ্নদর্শী হতে হয়। আশা করি লেখক বাপ্পী খান বিষয়গুলোর দিকে নজর দেবেন পরবর্তী লেখার সময়।
যেমন-
[পৃষ্ঠা: ১৭]
উদাহরণ-০২:
[পৃষ্ঠা: ২৩]
সবিশেষ
ওভারঅল নিশাচর পড়ে আনন্দ পেয়েছি। আর অজানা অধ্যায়ের কথা বলেছিলাম। এই বইয়ে পুলিশের কর্মতৎপরতা বাপ্পী অনেক সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন। অনেকগুলোই আমরা সাধারণরা জানি না। পুলিশকে গালি দিয়ে আনন্দ পাই। কিন্তু তারা যে একটা আনন্দময় প্রোগ্রামেন জন্য কতটা পরিশ্রম করে যান, তা আড়ালেই থেকে যায় সবসময়। বাপ্পীকে ধন্যবাদ এগুলো সুন্দরভাবে তুলে আনার জন্য।
এই বই পড়ে লেখক বাপ্পী খানের কাছে প্রত্যাশা বেড়ে গেলো। নেক্সট বইয়ের চাহিদা তৈরি হলো আমার মতো একজন পাঠকের মনে। শুভকামনা জানাই লেখককে। সুন্দর বই উপহার দেয়ার জন্য লেখক প্রকাশক দু’জনকেই ধন্যবাদ।
Sagarika Ray says
valo laglo review