ব্রাত্য রাইসুর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মহান গল্পকার হুমায়ূন আহমেদ। খুবই সাদাসিদেভাবে- ব্রাত্য রাইসু: যে মাঝে মাঝে হিমুর মতো হাসে। হিমুর মতো হাসেন? কী আচানক! আমি বেশ আগ্রহ বোধ করলাম এই লোকটার ব্যাপারে। কী করেন উনি? খালি পায়ে রাস্তায় হাঁটেন? পূর্ণিমা দেখতে গাজীপুর জঙ্গলে যান? বালুতে গর্ত করে মাথা বের করে চাঁদ দেখেন?
সেটা ১৯৯৯ সালের কথা। স্কুল লাইফ শেষ করে কলেজে পা দিয়েছি। উদ্যমে ভরপুর। নতুন নতুন চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি ব্যাপার নাক সিটকে বাতিল করে দিই। নিজেই নতুন করে সেগুলো রচনা করার চিন্তা করি। ব্রাত্য রাইসু আমার মাথা থেকে খুব শিগগিরই দূর হয়ে গেলেন। সৃষ্টিতত্ব নিয়ে আমি তখন অদ্ভুত সময় পার করছি। ইন্টারমিডিয়েটের দু’বছর আমার কীভাবে পেরিয়ে গেলো; জানিও না। কোনোরকমে পাশ করে ফেললাম দুর্জনদের মুখে ছাই দিয়ে। নারায়ণগঞ্জ থেকে চলে এলাম এই ইট-কাঠ-পাথরের ঢাকা শহরে। ব্রাত্য রাইসুকে নতুন করে চিনলাম এখানে।
ব্রাত্য রাইসু- একজন কবি। শুধুই কবি? আমার কাছে তাই। তাঁর আরও পরিচয়ের চেয়ে একজন কবি হিসেবেই তিনি নিজের আসন পোক্ত করেছেন। এরকম সার্টিফিকেটে ব্রাত্য রাইসুর কিছুই যায় আসে বলে আমার মনে হয় না। তিনি তিনি-ই। আর এই ব্যাপারটাই ব্রাত্য রাইসুকে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি বড় করে তুলেছে। কোনো এক বিখ্যাতজন সম্ভবত এরকম একটি কথা বলেছেন- একজন কবি যখন হেঁটে যাবেন, একজন গদ্যকার রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াবেন।
আমরা সবাই কবিকে মহান করে দেখি। আমার জানামতে একমাত্র ব্রাত্য রাইসুকেই দেখেছি যিনি এই কথার বাস্তবতা মানেন। ব্রাত্য রাইসু নিজের ভেতর এই কথা লালন করেন। তিনি চাটুকার কেন, কে, কী প্রশংসা করলো সেগুলোও থোরাই কেয়ার করেন। তিনি প্রশংসার উর্ধ্বে যেতে পেরেছেন বলেই মনে করি।
রাইসু কি তবে অহংকারি?
অবশ্যই।
একজন মানুষ তখনই কবি হন, যখন তিনি অহংকারি হয়ে উঠতে পারেন। মেকি অহংকারি নয়, সত্যিকারের অহংকারি। যেমনটা ব্রাত্য রাইসুর মধ্যে দেখেছি।
ভালো কবিতার সমঝদার,
আপনেরে আমার কী দরকার?
আমি লেখমু কবিতা আর আপনে কইবেন ভালো
লেখক-পাঠক ভালোবাসার সেই দিন ফুরাইলো।
[আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি/ব্রাত্য রাইসু, ২০০১]
দুই.
ঢাকায় আসার পর শাহবাগ বেশ আড্ডা দিই। অদ্ভুত সব গল্পের প্লট মাথায় আসে। সেগুলো লেখার চেষ্টা করি। বিশিষ্ট লেখকদের বাসায় যাই, গল্প করি। এই সময়ে ব্রাত্য রাইসু আমার চিন্তা-চেতনায় নতুন করে উদয় হলেন। হুমায়ূন আহমেদের সেই পরিচয় করিয়ে দেয়া আবারও মনের ভেতর টের পেলাম- ব্রাত্য রাইসু: যে মাঝে মাঝে হিমুর মতো হাসে। সত্যিই কি তিনি হিমুর মতো হাসেন?
ব্রাত্য রাইসুকে প্রথম কাছ থেকে দেখি কত সালে, ঠিক মনে নাই। ২০০২-২০০৬ সালের মধ্যে যেকোনো সময় হতে পারে। তবে আগে পরেও পারে হতে। শাহবাগ কিংবা আজিজ সুপারমার্কেটে। কয়েকজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম- হাসি দেখার জন্য। তাঁর হাসি সুন্দর। হিমুর মতো? হিমু কীভাবে হাসেন? জানা নাই আবার জানা।
এই সময় ব্রাত্য রাইসু আমার উপর ভর করলেন সিন্দবাদের ভূতের মতো। লিখতে গেলেই ভাষা কেমন যেন হয়ে যায়! খেয়াল করে দেখলাম সেটা আর কিছু নয়, ব্রাত্য রাইসুর লেখার স্টাইলটাই আমার কলমে প্রবাহিত হচ্ছে। অদ্ভুত ধরণ সেই লেখার। পড়তে গেলে আশ্চর্যরকম লাগে। ভালো কিংবা মন্দ? বুঝতে পারি না। শুধু আশ্চর্যরকম লাগে। এতোই আশ্চর্য যে, লিখতে গেলে সেভাবেই চলে আসে। এরকম করে বেশ কয়েকটা ছোটগল্পও লেখা হলো। লিটলম্যাগের সম্পাদকরা সেসব গল্প বেশ পছন্দও করলেন। তারপর কেটে যেতে লাগলো আরও বহুকাল।
তিন.
ব্রাত্য রাইসুর ফাঁদে (?) তৃতীয়বারের মতো পড়লাম এই ভার্চুয়াল জগতে এসে। ফেসবুকের জয়যাত্রা তখন। সেখানেই রাইসুকে নতুন করে আবিষ্কার করা। সাহস করে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানো। একসেপ্ট করার পর সেই কি উল্লাস! ভয়ে ভয়ে রাইসুর স্ট্যাটাসে লাইক, কমেন্ট করা। সারাদিন রাইসু অনেকগুলো করে স্ট্যাটাস দেন, কবিতা পোস্ট করেন। পড়ি, ভালো লাগে।
তারপর একদিন আরও এগিয়ে গিয়ে ইনবক্সে নক। টুকটাক আলাপ। সেই আলাপও অদ্ভুতরকম। একটা প্রশ্ন করলে উত্তর দেন। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি। আবার কখনও বলেন- আমি ইনবক্সে প্রশ্নের উত্তর দিই না।
কবি ব্রাত্য রাইসুর সাথে মুখোমুখি আলাপ ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৫ তে। একুশে বইমেলায়। আগেই ফোনে কথা হয়েছিলো। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে কয়েকজনের সাথে আলাপ করছিলেন। এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিতেই হাসলেন, অদ্ভুত সেই হাসি।
সম্ভবত বুঝতে পারছিলেন আমি আনিজি ফিল করছিলাম অন্যদের সামনে কথা বলতে। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে টেনে নিলেন। অদূরবর্তী একটা বেঞ্চে গিয়ে আমরা বসলাম। দেখা হলো। কথা হলো। প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বার। কেন? অদ্ভুত এক বদঅভ্যাসে অভ্যস্ত আমি। প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকতেই ভালো লাগে। প্রিয় হন যে কারণে সেগুলোর দিকেই মনোযোগ দিই। ব্রাত্য রাইসু প্রিয় হওয়ার কারণ তাঁর লেখা। তাঁর লেখাকেই এখন তাই হাতের কাছে রাখি। অদ্ভুতরকমের মন খারাপ হয় যখন, কিংবা অদ্ভুতরকমের ভালো লাগা থাকে মনে, আমি হাতের কাছ থেকে টেনে নিই আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি কিংবা হালিকের দিন। মনে মনে, গুগগুনিয়ে কিংবা কখনো-সখনো জোরে জোরে পাঠ করি- গ্রামবাংলায় আমরা, আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি, স্তন, ছাগল, বাচ্চা মেয়ের জন্যে প্রেম, দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে… পর্যটক ঘুরিতেছে, রাষ্ট্র এক মোয়া, মেয়েলোকটার সঙ্গে আসা ছেলেলোক দুইটারে, বড়লোকদের সঙ্গে আমি মিশতে চাই, গোলাপ ইত্যাদি।
ব্রাত্য রাইসু সম্পর্কে ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোশ্চেন:
নাম?
ব্রাত্য রাইসু।
পেশা?
কবি। [তবে এই ব্যাপারে দ্বিমত থাকতে পারে। ফেসবুক ইনবক্সে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর দেননি।]
কী করেন?
কবিতা লিখেন, ছবি আঁকেন, সম্পাদনা করেন, ভাষা নির্মাণ করেন…
বয়স?
৩০-৩৫ বছর [কমবেশি হতে পারে। আমার যা মনে হলো তাই লিখেছি।]
জন্মতারিখ?
১৯ নভেম্বর।
গ্রামের বাড়ি?
সম্ভবত কুমিল্লা। অন্যত্রও হতে পারে। যেখানেই হোক, আমার কী?
উনি কি বিখ্যাত ব্যক্তি?
অবশ্যই। কবি জয় গোস্বামী একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন কবি আল মাহমুদ এবং কবি ব্রাত্য রাইসুর সাথে দেখা করার জন্য। আল মাহমুদের সাথে দেখা হয়েছিলো কিন্তু ব্রাত্য রাইসুর সাথে দেখা করতে পেরেছিলেন কিনা জানা নেই। তবে এটা বড় কারণ নয়। রাইসু এমনি এমনি বিখ্যাত ব্যক্তি। বিখ্যাত হওয়ার জন্যই তিনি বিখ্যাত।
কেমন মানুষ?
খুবই অহংকারি।
হাসি?
হিমুর মতো।
হিমুর হাসি কেমন?
ব্রাত্য রাইসুর মতো।
সবচেয়ে ভালো দিক?
যা ভাবেন তাই প্রকাশ করতে পারেন। করেনও।
পরিশিষ্ট
লেখাটা ২০১৭ সালে লেখা। ব্রাত্য রাইসুর জন্মদিন উপলক্ষে শ্রদ্ধেয় নাদিয়া ইসলাম লেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন পর্যন্ত রাইসুর সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছিলো। দ্বিতীয়বার দেখা হয় পারমিতা হিমের বুক সাইনিং প্রোগ্রামে- পাঠক সমাবেশ লেখক-পাঠক কেন্দ্রে। ২০১৮ সালে। আমাকে দেখে রাইসু ভালো মানুষের মতো জানতে চাইলেন- আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে। নাম যেন কি আপনার? এরকম একটা কঠিন প্রশ্ন এতো সাবলিলভাবে করে ফেলা যায়! আমি প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললাম। আর সাথে সাথেই বললেন- আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনার অনুবাদ বইটা আমি কিনে পড়বো।
তখন বেশ পুলকিত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ব্রাত্য রাইসুকে আমার বলা দরকার- ঐ বই আপনার না পড়াই ভালো। বাজে অনুবাদ। বিরক্তিকর।
যেহেতু রাইসু বইটা এখনও পড়েনি, এবং না পড়তে অনুরোধ জানাচ্ছি, তাইহেতু একটা তথ্য এখানে লিবিবদ্ধ করা যাক: শ্রদ্ধেয় কবি ব্রাত্য রাইসু, ঐ বইয়ের পরতে পরতে অনেক লাইন-ই আপনার বাক্য লেখার স্টাইলের সাথে মিল আছে। আপনি এখনও সিন্দবাদের ভূতের মতো আমার কলমের ডগায় আটকে আছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়- আমি এজন্য আনন্দিত। আপনার কাছে আমি শিখেছি- কীভাবে আক্রমণকারি ব্যক্তিকে পাল্টা আক্রমণ না করেও সমুচিত জবাব দেয়া যায়।
আজ ১৯ নভেম্বর, আপনার জন্মদিনে অনেক অনেক শুভকামনা। শুভ জন্মদিন, ব্রাত্য রাইসু।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.